দুপুরের খাবার শেষ করে এসে শরীরটাকে চেয়ারে এলিয়ে দিলাম। আজকাল অফিসে খুব কাজের চাপ যাচ্ছে। লাঞ্চের সময়টাও ঠিক মতো পাওয়া যায় না। খুব ক্লান্তি অনুভব করছি। এ সময় ঘুম ঘুম একটা ব্যাপার চলে আসতে পারে। ভাবলাম,
একটু বিনোদন দরকার,
ঝিমুনি আসবে না। ইউটিউব-এ কমেডি নাটক খুঁজতে লাগলাম। একটু একটু করে কয়েকটা নাটক দেখলাম। কিন্তু কোনটাতে মন বসল না। ফিরে আসলাম জি-মেইলে। ব্রাউজারের সর্বাপেক্ষা বাম পাশের ট্যাবে আমার ব্যক্তিগত জি-মেইল আইডিটা সব সময় খোলা থাকে। হঠাৎ একটা নোটিফিকেশান। কেউ একজন আমাকে গুগল প্লাস-এ অ্যাড করেছে। নাম
Kevin Austin (কেভিন অস্টিন)। প্রোফাইলে নিজের সম্পর্কে কিছুই লেখা নেই। শুধু একখানা ছবি।
নাম আর ছবি দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে,
তিনি বিদেশিনী। হাতে ডাল-পাতাসহ দুইটি গোলাপ। গোলাপ দুইটি নাকের কাছে ধরে রেখেছে, গন্ধ উপভোগ করবার চেষ্টা করছে। মুখে ছোট্ট মিষ্টি হাসি। মাথায় সোনালি চুল কিন্তু চোখ সাদা, যাকে বলে ক্যাট'স আই। আমি কিছুক্ষণের জন্যে ওই ছবিটির মধ্যে হারিয়ে গেলাম। ওকে ভালো করে দেখতে লাগলাম। মাথার সামনের দিককার চুলগুলো কেটে ছোট করা কিন্তু পেছনের চুলগুলো বেশ বড়। সামনের ছোট চুল চূর্ণ হয়ে কপালে পড়েছে। ভারি সুন্দর একখানা সাদা মুখ, কিন্তু ওই ঘোলা চোখ দুইটি আমার কাছে চাঁদের গায়ে দাগের মতো মনে হলো। মনে মনে ভাবলাম, চোখ দুইটি নীল হলে কী এমন ক্ষতি হতো? এ যেন স্রষ্টার এক প্রিয় খেলা। সব সুন্দরের মধ্যে বেমানান-অসুন্দর কিছু একটা তিনি দিয়েই রাখবেন। এ না হলে স্রষ্টার খেলা যেন পূর্ণতাই পায় না। স্রষ্টাকে নিয়ে গবেষণা করতে করতে মনটা বলে উঠল, বোকার মতো এ আমি কী ভাবছি? ওর চোখ সাদা, কালো বা নীল, যা-ই হোক না কেন, তাতে আমার কী? ও তো আমার কেউ নয়! হ্যাঁ,
সত্যিই তো,
ও তো আমার কেউ নয়। তবুও মন কেন এসব কথা বলে! মনের কী দোষ? দু'চোখ ভরে দেখবার জন্যেই যেন জগতের সকল সৌন্দর্যের জন্ম। কোন কোন সুন্দরকে মন তার নিজের করে পেতে চায়। মনের এই মাতব্বরি আমরা খুব একটা সামাল দিতে পারি না। এটাই জগৎ-সংসারের নিয়ম।
কেভিন অস্টিন,
ডান হাত দিয়ে গোলাপের ডাল দু'টি ধরে রেখেছে। হাতের নখ আর আঙুলগুলো লম্বা লম্বা। নখে আবার মেরুন কালারের নেইল পলিশ। ও যেন অপলক দৃষ্টিতে আমারই দিকে তাকিয়ে আছে। ছবিটা যখন তোলা হয়েছিল,
ও তখন ক্যামেরার দিকে তাকিয়েছিল,
সেজন্যেই এমন মনে হচ্ছে। আমার কানে ভেসে আসতে লাগল রবীন্দ্রনাথের সেই গান, "আমি চিনি গো চিনি তোমারে,
ওগো বিদেশিনী..." রবীন্দ্রনাথ যদিও এ গান আমার জন্যে লেখেননি,
তথাপি এ মুহূর্তে এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে এ গান আমারই জন্যে লেখা হয়েছিল। আমি ক্ষণিকের জন্যে নিজের মধ্যে ফিরে এলাম। নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম,
উত্তরও পেলাম- আমি এই ছবিটির প্রেমে পড়েছি। সেলফির ওই সাদা হাতখানা দেখে মনে হচ্ছিল- এ হাত আমার। এ হাত আমি সারা জীবন নিজের হাতে আগলে রাখব, এ হাত আমি হারিয়ে যেতে দেব না, এ হাত আমি আজীবন আমার বুকের ওপর রেখে দেব, এ হাত আমি কপালে ছোঁয়াব, এ হাতে হাত রেখে আমি পূর্ণিমার চাঁদ দেখব, এ হাতে হাত রেখে আমি জীবনের সকল তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ সাগর পাড়ি দেব।
মেয়েটিকে নিয়ে এমন ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চেয়ারম্যান স্যারের ডাক আসল। আমি তড়িঘড়ি করে উঠে গেলাম। স্যারের সাথে দেখা করে আবার ফিরে আসলাম। আমার মনটা একটু চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম। শুনেছি মানুষ প্রেমে পড়লে বোকা হয়ে যায়। কিন্তু আমি মেয়েটিকে নিয়ে যেভাবে ভাবছি,
সেটা বোকামির চেয়েও বেশি। এই বত্রিশ বছর বয়সে স্কুল-কলেজের ছেলেদের মতো চিন্তা করাটা আমাকে একদম মানায় না। একটা বিদেশি মেয়ে। জাস্ট আমাকে গুগল প্লাস-এ অ্যাড করেছে। তথ্য-প্রযুক্তির এই আধুনিক যুগে এটা অত্যন্ত সাধারণ একটা ব্যাপার। আর আমি কিনা তাকে নিয়ে মনে মনে মহাকাব্য রচনা করে চলেছি! হতে পারে মেয়েটি বিবাহিতা আবার এমনও হতে পারে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। বিবাহিতা হোক বা না হোক, কাউকে ভালোবাসুক বা না বাসুক, তাতেই বা কী? আমি কেন এসব ভাবছি? অযৌক্তিক,
অর্থহীন। নিজের ওপর খুব বিরক্তি লাগল। কিন্তু কী করব? চেষ্টা করেও মেয়েটিকে মন থেকে তাড়াতে পারছি না। মেয়েটিকে নিয়ে আমি ভাবছি বললে ভুল হবে। আমার মন ভাবছে, মনকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। ঘোলা চোখ আমার কোনদিন পছন্দ নয়। যাদের চোখ ঘোলা, তাদের মনটাও ঘোলা, পড়া যায় না। অথচ এই এক জোড়া ঘোলা চোখ আমার মনের আকাশে সাইক্লোন বইয়ে দিচ্ছে। এ যেন নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ,
সত্তার সাথে সত্তার খেলা।
সবকিছুর পরেও নিজেকে এতোটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম যে, আমি এখন অফিসে আছি। আমি একটা ডিপার্টমেন্টের প্রধান। আমার ওপর অনেক দায়িত্ব। এমনিতে কাজের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছি। তারপর যদি আবার এসব আজে বাজে চিন্তা করে সময় নষ্ট করি, তাহলে সেটা আমার পেশাদারিত্বকে অসম্মান করবে। এই অফিস, এই কাম্পেনি আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। গ্র্যাজুয়েশান শেষে এখানে ইন্টার্নশিপের জন্যে এসেছিলাম। ইন্টার্নশিপটা আর শেষ করতে হয়নি, তার আগেই এই কাম্পেনি আমাকে অ্যাপয়েন্ট করে। চাকরি অবস্থায় পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান করেছি। শুরু থেকে এ পর্যন্ত ছয় বছর অতিবাহিত হয়েছে। এখন আমি একটা ডিপার্টমেন্টের প্রধান। এ কাম্পেনি আমাকে যা দিয়েছে, তার প্রতিদানে আমারও অনেক কিছু দেবার আছে। সুতরাং, সবার আগে আমার কাজ, আমার দায়িত্ব। গুগল হ্যাংআউটে গিয়ে মেয়েটির জন্যে শুধু একটি বাক্য লিখলাম,
"থাঙ্ক্স ফর অ্যাডিং মি।"
তারপর কাজে মন দিলাম।
বাসায় গিয়ে রাতে কম্পিউটারের সামনে বসলাম। মেইল চেক করলাম, কয়েকটা মেইলের উত্তরও দিলাম। মেয়েটির কোন খোঁজ-খবর নেই। এরপর প্রায় এক সপ্তাহ গেল, মেয়েটিকে একবারের জন্যেও অনলাইনে দেখলাম না। অবশ্য এ কয়দিনে ওকে নিয়ে আমার মনের চঞ্চলতাটাও অনেক কমে গেছে। মানুষের মনে বিভিন্নভাবে প্রেম আসে। কোনটা নোটিস দিয়ে আসে আবার কোনটা গোপনে আসে, বিনা নোটিসে। যে প্রেম গোপনে আসে, গোপনে হাসায়, গোপনে কাঁদায়, সে প্রেম কতটা মধুর বা কতটা যন্ত্রণার, তা কেবল সে-ই জানে যার মনে এমন প্রেম বাসা বাঁধে। আমি, জীবনে কোনদিন প্রেম করিনি। আবশ্য প্রেমে পড়িনি তা বলব না, পড়েছি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেয়ের প্রেমে পড়েছি। কিন্তু কাউকেই মনের কথাটি বলা হয়নি। বলি বলি করে বলা হয়নি। কোন এক সময় মনে হয়েছে- বলব না, যদি সে ‘না’ বলে দেয়, তাহলে মান-সম্মান যাবে। তার চেয়ে সেই ভালো, মনের কথা মনেই থাকুক। কাউকে কিছু বলিনি এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও ঠিক যে, কারও জন্যে মন কখনও খুব বেশি উতলা হয়নি। কিন্তু এই একটি ছবি বিনা নোটিসে আমার হৃদয়ের অ্যালবামে ঢুকে পড়েছে আর আমাকে অনেকটাই উতলা করে দিয়েছে।
সেদিন অফিসেই ছিলাম। হঠাৎ আমার কম্পিউটারে ‘কড়াং’ করে একটা শব্দ হলো ।কারসরটা বাম পাশের ট্যাবের ওপর নিয়ে ক্লিক করলাম। দেখলাম- আশার মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরেছে। কেভিন আমাকে লিখেছে, ‘হাই’। সাথে সাথে আমিও লিখলাম, ‘হাই’।
উল্লেখ্য যে, ওর সাথে আমার কথোপকথন হয় শুধু ইংরেজিতে। এখানে আমি সেসব কথোপকথনের বঙ্গানুবাদটাই লিখছি। অবশ্য দু’একটি বাক্য ইংরেজিতেও লিখব কথার ছন্দ ধরে রাখার জন্যে।
কেভিন আমাকে জিজ্ঞেস করল-
‘তুমি কোথা থেকে?’
‘আমি বাংলাদেশ, তুমি?’
‘আমি জার্মানি থেকে, তবে বর্তমানে আছি ইউকেতে।’
‘ও আচ্ছা’
‘তোমার আফিসিয়াল নাম কী?’
আমি বললাম, ‘ফারুক আল মাহমুদ, তোমার নাম?’
‘আমার প্রোফাইলে যেটা দেখতে পাচ্ছ সেটাই, কেভিন অস্টিন।’
‘তোমার প্রোফাইলে তো
তোমার নাম ছাড়া আর কিছুই নেই, নিজের ইনফরমেশান দাও না কেন?’
‘না, এমনিতেই, আমি আসলে অনলাইনে খুব একটা সময় দিতে পারি না। যা-ই হোক, আমি কি তোমাকে কয়েকটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?’
আমি লিখলাম, ‘হ্যাঁ অবশ্যই, কী জানতে চাও, বল!’
প্রায় দুই তিন মিনিট হয়ে গেল। ও আর কিছুই লিখছে না। আমি আবারও লিখলাম, ‘হ্যালো, তুমি কী প্রশ্ন করবে বলেছিলে?’
‘ও হ্যাঁ, এই যেমন তোমার বয়স, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, বৈবাহিক অবস্থা ইত্যাদি।’
আমি কিছুটা অবাক হলাম। ও যেসব বিষয়ে জানতে চেয়েছে, তা সবই ঠিক আছে। কিন্তু বৈবাহিক অবস্থা জানতে চায় কেন। অবশ্য বৈবাহিক অবস্থা ছাড়া আর সবকিছুই আমার প্রোফাইলে দেয়া আছে। দেখেনি নাকি? দেখুক বা না দেখুক, ও যখন জানতে ছেয়েছে, তখন আমাকে বলতে হবে। আমি ওর সব প্রশ্নের উত্তর একসাথে লিখে দিলাম, ‘আমার বয়স ৩২, আমি মার্কেটিং-এ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট, বর্তমানে একটি কাম্পেনিতে মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের প্রধান হিসেবে কাজ করছি এবং আমি অবিবাহিত।’
চলবে ...
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে নিচের সোশ্যাল মিডিয়া শেয়ারিং বাটনগুলো ব্যবহার করতে পারেন। এই ব্লগের ধারাবাহিক পোস্ট সম্পর্কে আপডেট পেতে আপনি আমার ফেসবুক পেইজে (https://www.facebook.com/ihtareq1971)
লাইক দিয়ে নোটিফিকেশান অন রাখুন। এই পোস্টে ইতিবাচক মন্তব্যের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।